Showing posts with label Alberto Granado. Show all posts
Showing posts with label Alberto Granado. Show all posts

21 March 2011

শেষ হল মোটরসাইকেল ডায়েরিঃ চলে গেলেন আলবার্তো গ্রানাদো


দূর্বা ব্যানার্জী











সালটা ১৯৫১, পুরোনো একটা মোটরসাইকেলে চড়ে বেরিয়ে পড়েছিল দুই স্বপ্নসন্ধানী যুবক অভিযানের নেশায় আর্জেন্তিনা থেকে চিলির উদ্দ্যেশ্যে। দুই যুবকের মধ্যে ছোটোজন ২৩ বছরের এক ডাক্তারি ছাত্র নাম আর্নেস্তো চে গুয়েভারা, আর প্রায় বছর ছয়েকের বড় যুবকটিও ডাক্তারির ছাত্র, নাম আলবার্তো গ্রানাদো। ছোটো চে অনেকদিন আগেই ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে বিপ্লবের নতুন সংজ্ঞা শিখিয়ে চলে গেছেন, ২০১১ সালের ৫ই মার্চ চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে দিয়ে দ্বিতীয় স্বপ্নসন্ধানী যুবক, আজন্ম বিপ্লবী, মানবমুক্তির সংগ্রামের অবিস্মরণীয় ভগীরথ ৮৮ বছরের আলবার্তো গ্রানাদো ।

আর্জেন্টিনার কোরডোবাতে ১৯২২ সালের ৮ই আগষ্ট জন্ম হয় চের মোটরসাইকেল অভিযানের সঙ্গী আলবার্তো গ্রানাদোসের । গ্রানাদোর বাবা ডিওনিসিও টি গ্রানাদোস ছিলেন আদতে স্প্যানিশ, আর্জেন্টিনায়ে রেলকর্মচারী থাকাকালীন তিনি সক্রিয়ভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান গ্রানাদোস কেমিস্ট্রি এবং বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে কোরডোবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করার পর স্থানীয় লেপ্রোসিস্যানাটোরিয়ামে কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে বায়োলজিকাল সায়েন্সে ডক্টরেট ডিগ্রীর অধিকারী হয়েছিলেন গ্রানাদোস।

নিত্য দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা এই দুই যুবক নতুনের খোঁজে পাড়ি লাগিয়েছিল তাদের ১৩বছর বয়সী প্রিয় মোটসাইকেল লা পোডেরসাবা দ্য পাওয়ারফুল কে সঙ্গে নিয়ে। দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার ধকলে অকেজো হয়ে যাওয়া প্রিয় মোটসাইকেল লা পোডেরসাকে চিলির মাটিতেই বিসর্জন দিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো কোনো চলতি গাড়িতে করে দুই বন্ধু এগিয়ে গিয়েছিল মানুষের দুঃখ, দারিদ্র্য, শোষণের হাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজার জন্য। এই যাত্রার অভিজ্ঞতা তাঁরা দুজনেই ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন যার উপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালে ওয়াল্টার সেলস্ বিখ্যাত মোটরসাইকেল ডায়েরী সিনেমাটি তৈরী করেন। দুই বন্ধুই মার্কসীয় আদর্শে অবিচল ছিলেন; রাজনৈতিক সচেতনতার জন্য গ্রানাদোস ১৯৪৩ সালে আর্জেন্টিনার মিলিটারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বেশ কিছুদিনের জন্য তাঁর  কারাবাস হয়েছিল।  

কেবলমাত্র দেশভ্রমণ বা অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেই তাঁরা বেরিয়ে পড়েননি। দীর্ঘ এই পথে চলার সময় তাদের মনে বহু চিন্তা এসেছিল, গ্রানাদোসের উক্তি থেকেই জানা যায় সেই সম্পর্কে। গ্রানাদোস লিখেছিলেন তাঁর ডায়েরীতে, আমি সমগ্র বিশ্বকে দেখতে চাই, কিন্তু সবার আগে দেখতে চাই আমার নিজের ভুমি লাতিন আমেরিকাকে। তবে তা এক ভ্রমনার্থীর দৃষ্টি দিয়ে নয় যে কেবলমাত্র আনন্দের জন্য, সৌন্দর্যর প্রতি আগ্রহী, আমি দেশের একজন মানুষের আকাঙ্খা, সাহসের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাই। সেইভাবেই দেখেছিলেন গ্রানাদোস তাঁর লাতিন আমেরিকাকে। বয়সে বড় হলেও চের সাথে গ্রানাদোসের সাহিত্য, রাজনীতি বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ির সময়। প্রায় সাতমাসের উপর লাতিন আমেরিকার পথে প্রান্তরে চলার সময় মানুষের চরম দুর্দশা দেখেছিলেন এই দুই যুবক; তবে চিলির এক তামার খনির শ্রমিকদের অবস্থা তাদেরকে সবথেকে বেশী আলোড়িত করেছিল। আমেরিকান মালিকানার এই খনিটিতে শ্রমিকরা প্রায় ক্রীতদাসের মতো পরিশ্রম করত ঊপার্জনের তাগিদে,তাদের মধ্যে বেশীরভাগই আক্রান্ত ছিল সিলিকোসিস রোগে । গ্রানাদোস তাঁর ডায়েরীতে লিখে গেছেন যে প্রথমে তাঁরা এই কারখানার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দ্বারা যথেষ্টই মুগ্ধ হলেও এখানকার উৎপাদিত পণ্যের লাভ ধনতান্ত্রিক দেশের সম্পদের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে এই তথ্য উপলব্ধি করে তাদের মনে চরম ঘৃণা ও ক্রোধের উদ্রেক হয়েছিল।

দুই যুবকের যাত্রা শেষ হয় ভেনেজুয়েলার কারাকাস শহরে। এরপর মানুষকে দুঃখ, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য দুই বন্ধুর সংগ্রামের পথ হয়ে যায় ভিন্ন। চে এগিয়ে যান সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে, তাঁর পরিচয় হয় কিঊবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে এবং নতুন সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যান পেরু, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর হয়ে। অন্যদিকে আর এক যুবক গ্রানাদোস ভেনেজুয়েলাতে থেকে যান এবং মানুষের চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে শুরু করেন সংগ্রাম। কুষ্ঠরোগ নির্মূল করার জন্য ক্রমাগত চর্চা চালিয়ে যান গ্রানাদোস এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষনা শুরু করেন । পরবর্তীকালে ১৯৬০ সালে চের আমন্ত্রণে তিনি বিপ্লবোত্তর কিউবাতে যান এবং একদিকে হাভানাতে চিকিৎসা শিক্ষা চালান, অপরদিকে সান্টিয়াগোতে একটি চিকিৎসা শিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। গ্রানাদোস এই সময়ে কেবলমাত্র চিকিৎসাক্ষেত্রেই চেকে সাহায্য করেন নি, তিনি ১৯৫৯ সালে আর্জেন্টিনার গেরিলাযুদ্ধের অনুশীলনেও যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। নতুন সংগ্রামের প্রস্তুতি এবং তাকে সফল করার কাজে চের সাথে সাথে যথেষ্ট অবদান ছিল আলবার্তো গ্রানাদোসেরও। চের মৃত্যুর পর জাতীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমগ্র দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন গ্রানাদোস।

গ্রানাদোস তাঁর ডায়েরীতে বারবার লিখেছেন কিউবার সংগ্রাম, কিউবার উন্নয়নে চে যেভাবে সততার সাথে তাঁর ভূমিকা পালন করেছিলেন অন্য কেউ তা হয়তো পারতেন না। একজন বিপ্লবীর দৃষ্টিতে এবং এক অভিন্নহৃদয় বন্ধুর দৃষ্টিতে তিনি চেকে পর্যালোচনা করেছিলেন। গ্রানাদোস চের সম্পর্কে লিখেছেন, চের চরিত্রের যে বিষয়টা আমি সবথেকে বেশি পছন্দ করতাম সেটা হল চের সততা...কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীকে ইতিবাচক অভিমুখে পরিবর্তন করানোর এক অসাধারণ বৈপ্লবিক ক্ষমতা ছিল চের।  

বর্তমানে যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠছে এবং শ্রেণী অসাম্য তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে সারা পৃথিবীজুড়েই, এই অস্থিরসময়ে আজ চের অভাব খুব বেশী করে অনুভূত হচ্ছে। আজ চে গুয়েভারাকে যখন কেবলমাত্র মার্কিনী ফ্যাসনের প্রতিকৃতি হয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁর সংগ্রামকে গৌন করে দিয়ে, তখন গ্রানাদোসের তার বন্ধুর সম্পর্কে বলা উক্তিটি মনে রাখার মতো, চে কোনো ভগবান নয় যাকে পুজো করতে হবে, তিনি একজন মানুষ ছিলেন যাঁকে অনুসরণ করে আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের সেরাটা প্রয়োগ করে কাজ করার চেষ্টা করতে পারি।”‘লা পোডেরসা সেই মোটরসাইকেলটা অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে চিলির রাস্তায়...চলে গেছেন চে গুয়েভারা, এবার চলে গেলেন সেই বিখ্যাত অভিযানের শেষ বিপ্লবী আলবার্তো গ্রানাদোস, যিনি নিঃশব্দে সবসময় পাশে ছিলেন চের আন্দোলনের এবং সারাজীবন নিজের সেরা কাজগুলো উজাড় করে সেবা করে গেছেন সমগ্র মানবজাতির