সুদক্ষিণা ধর
“আমাদের দেশের সিনেমা শুরুর ইতিহাসে ‘হলিউড’ ঘরানার বিশেষ প্রভাব দেখা যায়,কিন্তু ঋত্বিক ছিলেন হলিউডী প্রভাব থেকে একেবারেই মুক্ত। দেশজ আবহাওয়ায় চলচ্চিত্রের মৌলিক ভাষাটাকে ভেঙ্গে চুরে নতুন medium-এর হদিশ ঋত্বিকের ছবিতেই প্রাপ্তি ঘটে ভারতীয় দর্শকের। ঋত্বিক ঘটকের আটটি ছবিতেই হলিউডের প্রভাব মুক্ত চারিত্র্যধর্ম, চলচ্চিত্রের একান্ত নিজস্ব, ভাষা, প্রত্যেকটি ছবিতে দৃশ্য পরিকল্পনা রূপকল্প নির্মাণ, চলচ্চিত্রের আবহসৃষ্টি, ধ্বনিসংগীতের অব্যর্থ প্রয়োগ, দেশীয় লোকাচার ,লোকসঙ্গীত, মিথ, বিশ্বাস ইত্যাদি।উপস্থাপন ও প্রয়োগ নৈপুন্যে ঋত্বিক ঘটক একক ও অনন্য। তাঁর ছবিগুলিতে দেশভাগের যন্ত্রনা, উদ্বাস্তু সমস্যা, ছিন্নমূল মানুষের জীবন যন্ত্রনা, ভ্রান্ত রাজনীতি, নিয়ম নীতিহীন সংস্কৃতি-এরকম বিভ্রান্ত , হতাশ প্রিবেশের অসহায়তা, হতাশা ঋত্বিকের ছবিতে একেবারে নতুন আঙ্গিকে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
ঋত্বিক ঘটকের তিনটি ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ যেগুলিকে বহু সমালোচক ‘ত্রয়ী’ আখ্যা দিয়েছেন,সমগ্রভাবে ১৯৪৭র দেশভাগজনিত সমস্যার প্রতিফলক। ১৯৪৭এ ভারতবর্ষ স্বাধীনহয়েছিল,কিন্তু এই দেশভাগ এবং দেশভাগজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতি বাংলার জীবনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব-বিস্তার করেছিল। সারা দেশের মানুষের মতোই ঋত্বিক ঘটকের কাছে দেশভাগ ছিল একঅযাচিত, অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত ঘটনা। ১৯৪৭র ক্ষমতা হস্তান্তরকে ঋত্বিক বলেছেন “Great betrayal”, অর্জিত স্বাধীনতাকে বলেছেন খন্ডিত। আমাদের দেশের সমাজ অর্থনীতির স্তরেযে ঘনীভূত অব্যবস্থা, রাজনীতি সংস্কৃতিতে যে ব্যপ্ত নৈরাজ্য তার কেন্দ্রবিন্দুহিসাবে ঋত্বিক বঙ্গবিভাগকে চিহ্নিত করেছেন বারবার। বঙ্গভাগের ফলে উদ্বাস্তুমানুষগুলোর মূল্যবোধ পরিচিতির টানাপোড়েনে চিন্তিত ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিকের নিজস্ব মতে, তিনি ছবিতে যে বিষয়টি ধরতে চেয়েছেন “তা হচ্ছে আজকের বাংলাদেশেরঅর্থনৈতিক, রাজনীতিক ও সামাজিক সংকটের কথা” আর “এই সংকটের প্রথম বলি হচ্ছে বোধশক্তির বিসর্জন’’ ঋত্বিক ঘটককে অধিক মাত্রায় বিচলিত এবং ভাবিত করে তুলেছিল। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সমাজের মূল্যবোধ আদেশের অধ:পতন, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য এবংসর্বোপরি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনের স্বপ্ন ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রতি একটা নিদারুণ বিরাগ, বিরক্তি, হতাশা ও আবেগ তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি ছবিতে বর্তমান।
দেশভাগের ফলে উদ্ভুত ভাঙন, বিচ্ছিন্নতা, আদর্শগত বিচ্যুতি, মূল্যবোধের ভাঙণ, অথনৈতিক সমস্যা এই প্রত্যেকটি বিষয়কে ঝত্বিক তার এই ছবিগুলির মাধ্যমে মানুষের কাছে জ্ঞাপণ করেছেন ‘একটা কিছু করতে হবে’ এইইচ্ছায়। মধ্যশ্রেনী সুলভ আবেগে ঋত্বিক অনুভব করেছিলেন, চারপাশে যা ঘটছে তার প্রতিবাদকরা অবশ্যই প্রয়োজন; চারপাশের অন্যায় অপরাধকে নগ্ন করে দেওয়া প্রয়োজন।তাঁর চরিত্রছিল বলিষ্ঠ-এই বলিষ্ঠতার জন্যই ছবি করার প্রচলিত পদ্বতিগুলি না মেনে নিজের বক্তব্যকে সোজাসুজি তুলে ধরতে পেরেছিলেন। ঋত্বিকের ছবির চরিত্রগুলি আপাত বিচারে আত্মসমর্পণকরছে মনে হলেও ভিতরে ভিতরে তারা এক প্রতিবাদ তৈরী করে দেয় ঝত্বিকের ছবির প্রতিবাদগুলি সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে। তাঁর ছবির আশাবাদও তাই স্পন্দিত করে।
ঋত্বিকের নিজের জীবন এবং চলচ্চিত্র জীবনমিলিয়ে দেশভাগ ও দেশভাগ উদ্ভুত সমস্যা শুধুমাত্র সিনেমায় ব্যবহারের অলঙ্কার হিসেবেনয়, দেশভাগ তাঁর কাছে জীবন সংগ্রামের উৎস বেঁচে থাকার অধিকার হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটি প্রত্যক্ষ সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে যদিও এখানে অর্থনৈতিক সমস্যা প্রকট। ঐতিহাসিক ভাবেত্রিশঙ্কু মধ্যশ্রেণীর স্বার্থবোধ, নোংরামি সবই জন্ম নেয় অর্থনীতির চাপে-তা এখানে ধরা পড়ে। এই ছবিতে বৃদ্ধ পিতা মাতা বেকার ভাই-বোনদের দরিদ্র সংসারের দায়িত্ব মাথায়নিয়ে উদ্বাস্তু নেয়ে নীতা তার দাদা শঙ্করের ও প্রণয়ী সনৎ-এর প্রতিষ্ঠত হবার স্বপ্নদেখে এবং তার জন্য সমস্ত স্বার্থ নিজেকেও বলি দেয়। ঋত্বিক ঘটক নীতার উদ্দেশ্যেশঙ্করের মুখে একটা মজার কবিতা রেখেছিলেন “তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়/ গণেশকে সে বলে গনুশ।"
For the entire write up follow the link: http://www.thescape.in/bangla/newsdetail.asp?newsid=8
No comments:
Post a Comment